
গবেষণা
রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা কমেনি ধরন বদলেছে
- আপলোড সময় : ০১-০৯-২০২৫ ০৪:৪১:৪২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০১-০৯-২০২৫ ০৪:৪১:৪২ অপরাহ্ন


মিয়ানমার থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা আট বছরেও কমেনি। বরং তাদের প্রতি হওয়া সহিংসতার ধরন বদলেছে। এখনও প্রায় সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই যৌন হয়রানিকে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বাল্যবিয়ে ও বহুবিয়ে একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে স্থানীয়দের মধ্যেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বেড়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশ ও সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে আসে। অনুষ্ঠানে সরকারি সংস্থা, জাতিসংঘ, দূতাবাস, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা, গবেষক, বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশ নেন। গবেষণায় রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষাজনিত ঝুঁকি এবং তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, মাত্র সাত শতাংশ নারী স্বাধীনভাবে আইনি সহায়তা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এবং প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী (৪৮ শতাংশ) মনে করেন, পুরুষ ও ছেলেদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। এর পাশাপাশি, রোহিঙ্গা শিবিরে গড়ে ওঠা সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম এবং মাদকের বিস্তার তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ বিষয়ে বেশিরভাগ নারী ও কিশোরী মেয়ে (ক্যাম্পভেদে ৫০-৮২ শতাংশ) মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবাসনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তবে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা তৃতীয় কোনও দেশে অভিবাসনের কথা বলেছেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রায় সব রোহিঙ্গা নারী জানান, সুরক্ষার বিষয়ে মূল ভূমিকা পালন করে ক্যাম্প ইনচার্জ। তবে সেখানে যথাযথ প্রতিকার কিংবা আইনগত সহায়তা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। শতভাগ অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গা নারীরা জানিয়েছেন, সাজা হিসেবে শারীরিক নির্যাতন কিংবা রেশন কার্ড বাতিল করা হয়। আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে তারা জানান, পুলিশের কাছেও কিছু কিছু ঘটনা হস্তান্তর করা হয় কিন্তু তার ফলাফল অস্পষ্ট। বাস্তবে ক্যাম্প ইনচার্জ ছাড়া কেউ পুলিশের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। শুধু সাত শতাংশ অংশগ্রহণকারী নিজ উদ্যোগে আইনি প্রতিকার নেওয়ার উদ্যোগ কিংবা প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার ওপর ভরসার কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা নারীরা বলছেন, যথাযথ সুরক্ষার অভাবে কমিউনিটির কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার প্রাথমিক মেকানিজম হলো, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত মাঝি (ব্লক লিডার), ধর্মীয় নেতা কিংবা কমিউনিটি নেতার শরণাপন্ন হওয়া। তবে অভিযোগ পরবর্তী পাল্টা আঘাত অথবা ক্যাম্পে প্রাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে অনেকেই অভিযোগ করতে পারেন না। আর অভিযোগগুলো নিয়ে ফলোআপ না করায় অভিযোগ করতে অনীহা তৈরি হয়। সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেন। তারা বলেন, এই গবেষণার ফলাফল শুধু একটি তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন নয় বরং এটি রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীদের কণ্ঠস্বর, যা তাদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। অনুষ্ঠানে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, আমাদের গবেষণাটি ছিল অংশগ্রহণমূলক। রোহিঙ্গা নারীরা এখানে নিজেরা নিজেদের কথা বলার চেষ্টা করছেন। সেটাই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই নারীরা এখানে আছেন প্রায় আট বছর ধরে। মিয়ানমারে থেকে অন্যায়-অত্যাচার হয়েছিল বলেই তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা যখন এখানে আশ্রয় নেন তখন প্রাথমিক কোনও শেল্টার ছিল না। এখন কিছু হয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের প্রতি সহিংসতা কমেনি, বরং সহিংসতার ধরন বদলেছে। তিনি বলেন, এই গবেষণায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীরা আজ বহুমুখী ঝুঁকির মুখে। তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের জানান দিচ্ছে-সময় নষ্টের সুযোগ নেই। এখনই কৌশলগত পরিবর্তন এনে দীর্ঘমেয়াদি, অধিকারভিত্তিক ও জেন্ডার-সংবেদনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি, যা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট বার্তা রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের সুরক্ষায় অবিলম্বে অধিকারভিত্তিক ও জেন্ডার-সংবেদনশীল কৌশল প্রয়োজন। আলোচনায় বক্তারা জানান, এই সংকটটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা উচিত নয়, বরং এটিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। বাল্যবিয়ে, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং নারী ও মেয়েদের চলাফেবার সীমাবদ্ধতা যে শুধু প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিকতার কারণেই নয়, বরং ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের সীমাবদ্ধতার কারণেও ঘটিছে, তা আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া, সংলাপে পুরুষ ও ছেলেদের মানসিকতা পরিবর্তন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাউন্সেলিং কর্মসূচির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। বক্তারা মনে করেন, নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পুরুষদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। একইসঙ্গে, নারী-বান্ধব স্থান, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়, যা তাদের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন একশনএইড বাংলাদেশের হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড এনগেজমেন্ট কাজী মোর্শেদ আলম, হেড অব হিউম্যানিটারিয়ান প্রোগ্রাম মো. আব্দুল আলীম, পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার তামাজের আহমেদ। অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন- ইউএনএইচসিআর’র ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ জুলিয়েট মুরেকিসোনি, ইউএন উইমেনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলী সিং, ইউরোপীয় কমিশনের সুশাসন বিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যানেজার লায়লা জেসমিন, ঢাকার নেদারল্যান্ডস দুতাবাসের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজর মুশফিকা সাতিয়ার প্রমুখ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ